সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গল্পগুচ্ছ

শ্রোক- ১ 
শ্রীভগবান উবাচ
উর্ধ্বমূলমধঃশাখমশ্বথং প্রাহুরব্যয়ম ।
ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যস্তংবেদ স বেদবিৎ।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বলেছেন, উর্ধ্বমূল ও অধঃশাখাবিশিষ্ট েএকটি অব্যয় বৃক্ষের কথা বলা হয়াছে। বৈদিক মন্ত্রসমূহ সেই বৃক্ষের পত্রস্বরূপ। যিনি সেই বৃক্ষটিকে জানেন, তিনিই বেদজ্ঞ।
রানির হার
এক পরাক্রমশালী রাজার এক সুযোগ্য পুত্র ছিল। তিনি রাজপুত্রের সাথে এক অপূর্ব  সুন্দরী রাজকন্যার বিয়ে দেন। বিবাহের দিন রাজপুত্র , তার স্ত্রীকে ভালবাসার নিদর্শনস্বরূপ দুই কোটি টাকা দামের একটি হীরের হার উপহার দেন। রানি ঐ হারটিকে খুব পছন্দ করতেন এবং তাই তিনি সবসময় তা পরে থাকতেন।একদিন কাপড় পাল্টানোর সময়, তিনি হারটি জানালার ধারে রাখেন। হঠাৎ করে একটা কাক সেখানে উপস্থিত হয়ে হারটি নিয়ে পালিয়ে যায়।
তিনি তখন কেঁদে কেঁদে রাজপুত্রকে বললেন, ঐ হারটির বিনিময়ে যদি আমাকে ১০ কোটি টাকার হার ও দেয়া হয় তবুও আমি তা নেব না। ঐ হারটির প্রতি আমি বিশেষভাবে আসক্ত কারণ বিবাহের দিন তুমিই আমাকে সেটি দিয়েছিলেন। যদি তুমি আমাকে তা এনে দিতে না পার , তবে আমি আত্মহত্যা করব!”
রাজপুত্র পুরষ্কার ঘোষনা করলেন, “যে রানির হারটি এনে দিতে পারবে , তাকে ১০ কোটি টাকা পুরষ্কার প্রদান করা হবে।” রাজ্যের সকলে পুরষ্কার পাওয়ার লোভে পাগল প্রায় হয়ে উঠল।
একদিন , এক যুবক একটি ডোবার জলে রানির হারের মত উজ্জ্বল কিছু দেখতে পেল। সে খুব আনন্দিত হল এবং হারটি উদ্ধারের জন্য প্রবেশ করল । কিন্তু শ্রীঘ্রই সে বুঝতে পাল , “হায় হায় , জলের নিচে তো চোরা বালি ! আমি তো ডুবতে যাচ্ছি !” যে মাত্র সে জলের উপর ভাসমান হারটি নিতে গেল , হারটি আরো দূরে সরে গেল!! একই সাথে সে চোরাবালিতেও ডুবছে। কোন রকমে সে পুকুর থেকে উঠে জীবন বাঁচাল। সে সকাল থেকে সন্ধ্য পর্যন্ত হারটি উদ্ধার করার পেছনে কাঁটাল। যতবারই সে হারটি নিতে যায়, ততবারই তা তার থেকে দূরে সরে যায় এবং অন্যদিকে চোরাবালি তাকে ডুবিয়ে ফেলতে চায় । ভাগ্যবশত ঐ  সময়ে এক সাধু ব্যক্তি ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। যদি ও বালকটি এই বিষয়টি লুকাতে চাচ্ছিল, কিন্তু সাধু তা বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করল, “তামাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে । তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন তুমি সকাল থেকে কঠোর প্ররিশ্রম করছ? ’’  বালকটি বলল “না, না, আমি কিছুই করছি না। আমি কেবল এ স্থানের সৌন্দর্য  অবলোকনের জন্য এখানে এসেছি এবংডোবার জলের উপরিভাগে গুরুত্বপূর্ণ  কিছু নেই ।”  সাধু লেকটি বালকের অবস্থা বুজতে পেরে প্রতিজ্ঞা করল, “পুত্র!, আমি শুধু তোমাকে সাহায্য করতে চাই। আমি তোমার কাছ থেকে কিছু চাই না। তোমার কী সমস্যা? আমাকে বল।” বালকটি উজ্জ্বল হারটি দেখিয়ে তার সমস্যার কথা খুলে বলল, “যতবারই আমি ডুবতে নামি ততবারই অলৌকিকভাবে হারটি পাওয়ার জন্য আমি বেশিক্ষণ জলে থাকতে পারি না।”
মহাজ্ঞানী সাধুটি বলল, “পুত্র, তুমি সঠিক বিষয়টিই খোঁজছ, কিন্তু ভুল স্থানে । উপরে তাকাও ! বাস্তবে হারটি গাছের শাখায় ঝুলছে যেখানে কাক তা রেখে যায়। তুমি শুধুমাত্র এর প্রতিবিম্ব ধরার চেষ্টা করছ । তাই তুমি কখনোই তা পাবি না!!”
এই গল্প থেকে আমরা কী শিক্ষতে পারি?
ঠিক যে রকম জলের হারটি ছিল বাস্তবিক হারের প্রতিবিম্ব। ঠিক সেরকম েএই জড় জগতটি হল প্রকৃত জগত-আধ্যাত্মিক জগত বা ভগবানের রাজ্যর ক্ষণস্থায়ী প্রতিবিম্ব। প্রতিবিম্ব কিছু ক্ষেত্রে(অন্ধকারে নয়) সাময়িকভাবে দেখা যায় কিন্তু প্রকৃত জগৎ সর্বদাই বিরাজমান । একইভাবে ,সম্পূর্ণ জড় জগৎটি কিছুক্ষনের জন্য ক্ষনস্থায়ীভাবে তৈরী করা হয়ছে এবং নিদিষ্ট সময় পর তা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু প্রকৃত আধ্যাত্মিক জগত,আমাদের প্রকৃত আলয় সর্বদাই বিরাজমান।
অগভীর জলে বট বা আম গাছের প্রতিাবম্ব দেখে আম ধরার জন্য কেউযদি লাফ দেয়, তাহলে সে শুধু মাথায় প্রচন্ড আঘাতই পাবে!! প্রকৃত আম যেমন প্রকৃত গাছেই শুধু পাওয়া যায় তেমনি প্রকৃতআনন্দ শুধুমাত্র ভগবানের রাজ্যই বিদ্যমান
এই ক্ষণস্থায়ী জগৎটি প্রতি প্রদে প্রদে বিপদসঙ্কুল।ঠিক যেভাবে হরিণ মরুভূমির মরীচিকাময়জলের প্রতি আসক্ত হয়ে, জলের পেছনে দৌড়ায়। কিন্তু কখনোই তার নাগাল পায় না।  তেমনি এই জগতের সকলেই চিরতবর সুখী হওয়ার জন্য ছুটছে কিন্তু কখনোই তাতে সফল হয় না।  জীবকে হরিনের সাথে, এই জড় জগতকে মরুভূমির সাথে এবং মরীচিকাতে নয় বরং সমুদ্রে পাওয়া যায়  একইভাবে কেউ যদি  “সর্বদাই  সুখী জীবনযাপন” করতে চায় তবে তাকে অবশ্যই আধ্যাত্মিক জগৎ সর্ম্পকে আরো অনুসন্ধান করতে হবে এবং সেখানে পৌঁছার প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে ।
জড় অস্তিত্বের প্রতীক এই বৃক্ষটি সর্ম্পকে আমরা কি আরো বিশদ ভাবে জানতে পারি? তা আমরা পরের শ্লোকটিতে দেখব। 
“পরের কথায় , কিবা আসে যায়”
পিতা, পুত্র দুইজন হাট থেকে একটি ঘোড়া কিনে বাড়ীর দিকে ফিরছিলেন । পুত্র বলল, “বাবা! আপনি ঘোড়ার পিঠে উঠুন।” বৃদ্ধলোকটি তাই করল। কিছুদূর যাওয়ার পর কাতকগুলি লোক বলতে লাগল দেখ! বুড়োটার জ্ঞানবুদ্ধি বলতে কিছুই নাই । নিজে ঘোড়ার পিঠে চেপে ছেলেটিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।”
এই সমস্ত লোকের কথা শুনে বৃদ্ধ পিতা নেমে গেয়ে পুত্রকে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর কতকগুলি লোক বলতে শুরু করল,- “দেখ! দেখ! অতবড় ছেলেটার কোন কান্ডজ্ঞান নেই। বৃদ্ধ বাবাকে দিয়ে ঘোড়ার লাগাম ধরে টানাচ্ছে আর-ও-ঘোড়ার পিঠে চেপে আরাম করে যাচ্ছে ? এই কথা শুনে লজ্জিত হয়ে পুত্র ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এল।
এবার পিতাপুত্র স্থির করলেন, তাদের দুইজনেই ঘোড়ার পিঠে করে যাওয়াটাই ভাল। এই কথাটি স্থির করে দুইজনেই ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলেন। তখন আবার কিছুলোক বলতে লাগল-“তোমাদের বিবেকবুদ্ধি বলতে কিছুই নেই? একটি রোগা ঘোড়ার পিঠে তোমরা দুইজনইজওয়ান উঠেছ। ও বেচরার কষ্ট হচ্ছে না? তোমরা একেবারে বিবেকের মাথা খেয়ে বসেছ? এই কথা শুনে দুঃখিত হয়ে দুইজনেই ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে চলতে লাগলেন । আনার কিছু লোক বলতে শুরু করর -এদের মতো বোকা জগতে আর কেউ আছে ? টাকা দিয়ে ঘোড়া কিনে নিজেরা কষ্ট করে হেঁটে যায়? তখন দুইজনই চিন্তা করতে লাগলেন, এবার কি করা যায়? সামনে একটি সেতু পার হতে হবে। স্থির করলেন, ঘোড়ার চার পায়ে বেধেঁ ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই। এবং তাই করা হল। পথের লোকজন এই কান্ড দেখে হৈ হৈ করে হাততালি দিয়ে হাসতে লাগল। তথন ঘোড়াটি ছটফট করতে করতে দড়ি ছিঁড়ে নদীতে পড়ে গেল এবং সেইসঙ্গে দুইজনই পড়ে ঘোড়া ও পিতাপুত্র তিনজনই ইহলোক ত্যগ করলেন।
।। হিতোপদেশ ।।
কেউ যদি হরিভজনের পথ অবলম্বন করেন, তাহলে জগতের কামাসক্ত কৃষ্ণ বহির্মু খ মানুষ তাঁকে কত সমালোচনা করবে। তাঁকে জগতের কত লোক কত নিন্দা করবে। কিন্তু তাদের কথায় কান না দিয়ে হরিগুরু বৈষ্ণবের নির্দেশানুসারে চললে আমাদের প্রকৃত মঙ্গল হবেই হবে । সাধু-শাস্ত্র-গুরু বাক্য লঙ্গন করে জগতের লোকের কথা শুনলে উক্ত গল্পের ন্যায় সব্বনাশ হবে। (হরে কৃষ্ণ)

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন